এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের ঋণ সুবিধা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি তারা আমানতের টাকাও তুলতে পারবে না। এস আলম গ্রুপের মালিকানা রয়েছে এমন ৬ ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংক হলো– ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এর আগে সার্বিকভাবে এসব ব্যাংকের ঋণ বিতরণ সীমিত করা এবং এস আলমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব ধরনের শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এদিকে গত রোববার এস আলমের ৭ ভাই, স্ত্রী, সন্তানসহ ১৩ জনের ব্যাংক লেনদেন-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য চেয়েছে বিএফআইইউ।
গত বৃহস্পতিবার সমকালে ‘ব্যাংক থেকে এখনও শত শত কোটি টাকা তুলছে এস আলম’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কৌশলে ভেঙে ভেঙে টাকা তোলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এসআইবিএলের খাতুনগঞ্জ ও গুলশান শাখা থেকে টাকা উত্তোলনের সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য দেওয়া হয়। ওই দিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি তদন্ত টিম খাতুনগঞ্জ শাখায় পরিদর্শন শুরু করে। এ ছাড়া বিএফআইইউর একটি দল ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। ওই দিন ঋণ ও আমানত উত্তোলন বন্ধের নির্দেশনা দিয়ে ৬ ব্যাংকের এমডিকে চিঠি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, এস আলম গ্রুপ এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে থাকা আমানত, টাকা বা বৈদেশিক মুদ্রায় ফান্ডেড, নন-ফান্ডেড ঋণসহ যে কোনো উত্তোলন এবং স্থানান্তর বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হলো। এমনকি তাদের নামে কোনো ক্রেডিট কার্ড থাকলে তাতেও লেনদেন করা যাবে না। এখন থেকে এস আলমের নামে-বেনামে থাকা প্রতিষ্ঠান ও গ্রুপকে কোনো নতুন ঋণ সুবিধা দেওয়া যাবে না।
আগের ঋণ নবায়ন করা যাবে না। এসব প্রতিষ্ঠান ও গ্রুপের নামে অনুমোদিত ঋণ থাকলেও তার বিপরীতে কোনো ধরনের উত্তোলন সুবিধা দেওয়া যাবে না। সাধারণভাবে গ্রুপটির কোনো এলসি খোলা যাবে না। সম্পূর্ণ নিজস্ব উৎস থেকে শতভাগ নগদ অর্থ জমা সাপেক্ষে ঋণপত্র খোলা যাবে। এ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপের নামে অনুমোদিত ঋণপত্র বা গ্যারান্টির মেয়াদ থাকলেও নতুন করে সুবিধা দেওয়া যাবে না। তবে আগে ঋণপত্র খোলা হয়েছে, এমন দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বৈদেশিক মুদ্রা হিসাব, রপ্তানি প্রত্যাবাসন কোটা অথবা টাকার আমানত হিসাবে থাকা অর্থ ব্যবহার করা যাবে। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের বিল কেনা যাবে না। এমনকি কোনো পুনঃঅর্থায়ন সুবিধার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা যাবে না। তাদের যে কোনো মুদ্রায় ক্রেডিট কার্ড থাকলে লেনদেন বন্ধ করতে হবে। তবে প্রতিষ্ঠানের যে কোনো হিসাবে টাকা জমা করা যাবে।
গত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দখল করে নেয় এস আলম। এরপর ঋণের নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকটির ৮২ শতাংশ শেয়ার এস আলমের হাতে। আর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৫ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ এবং ৪৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে গ্রুপটির। অন্য চার ব্যাংকের বেশির ভাগ শেয়ার ও ঋণের সুবিধাভোগী এস আলম বলে জানা গেছে।
এস আলমের নামে-বেনামে থাকা শেয়ার হস্তান্তরে এরই মধ্যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। আর গত ১৯ আগস্ট এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৬ ব্যাংকের যে কোনো ঋণ বিতরণে বিধিনিষেধ আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই চিঠিতে বলা হয়, এসব ব্যাংক কৃষি, চলতি মূলধন, সিএমএসএমই, প্রণোদনা প্যাকেজ এবং নিজ ব্যাংকে রক্ষিত এফডিআরের বিপরীতে এসওডি ও শতভাগ নগদ মার্জিন ছাড়া কোনো বিনিয়োগ তথা ঋণ দিতে পারবে না। এসব খাতেও পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। আর নগদ আদায় ছাড়া বিদ্যমান বিনিয়োগ সুবিধা নবায়ন না করা, অন্য ব্যাংকের ঋণ অধিগ্রহণ না করা ও ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতা আদায়ের তথ্য মাসিক ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সাত ভাইয়ের অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব
এদিকে, রোববার এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম বা এস আলমসহ তাদের ৭ ভাইয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সব ধরনের তথ্য তলব করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ। সাইফুল আলম মাসুদের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর- ৫৯৬২৪৬৭৯৪৯। আর জন্ম ১৯৬০ সালের ১২ জানুয়ারি। ২০২২ সালে এস আলম ও তাঁর পরিবারের লোকজন দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে বিদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোজাহেরুল আনোয়ার ও মা চেমন আরা বেগম। বিদেশি নাগরিকত্ব নেন এস আলমের স্ত্রী ফারজানা পারভীন, দুই ছেলে আহসানুল আলম ও আশরাফুল আলম (২৪১৫৪৫২৬৫২)।
অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করা হয়েছে সাইফুল আলম মাসুদ এবং তাঁর ভাই মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ হাসান, ওসমান গনি, আবদুস সামাদ, রাশেদুল আলম, সহিদুল আলম ও মোরশেদুল আলমের। এ ছাড়া রোববার আরও কিছু অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করা হয়েছে। তারা হলেন– হামিদুর রহমানের ছেলে মিসকাত আহমেদ, আবুল কাশেমের মেয়ে ফারজানা বেগম ও ফেরদৌসুল কবিরের মেয়ে শাহানা ফেরদৌসের অ্যাকাউন্টের তথ্য তলবের তালিকায়। তারা এস আলম পরিবার-সংশ্লিষ্ট বলে জানা গেছে।