22 C
Dhaka
Friday, February 21, 2025

গরু-খাসির চেয়ে মাংসের দাম কম, সুন্দরবনে বেড়েছে হরিণ শিকার

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের মায়াবী হরিণ শিকারে মেতে উঠেছে শিকারি চক্র। সুন্দরবন এলাকায় তারা গত এক মাস ধরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গরু ও খাসির তুলনায় হরিণের মাংসের দাম কম হওয়ায় সুন্দরবনের আশপাশের এলাকায় এই বন্যপ্রাণীর মাংসের চাহিদা বাড়ছে। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে চোরাশিকারি চক্র।

সুন্দরবনের কোলঘেঁষা কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা, শ্যামনগর, মোংলা ও শরণখোলার মানুষ বেশি হরিণ শিকার করে। এসব এলাকায় হরিণের প্রতিকেজি মাংস ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর জেলা শহরে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা। চোরাশিকারিদের তথ্য প্রদানকারীকে বনের ভেতরে ২০ হাজার এবং বনের বাইরে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো।

জানা গেছে, খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা ও জোড়শিং এলাকায় হরিণ শিকারি চক্রের আধিপত্য বেশি। আর হরিণ পাচারের নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে বজবজা ও খাসিটানা বন টহল ফাঁড়ি এলাকা। এ ছাড়া মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের নয়ানি, হড্ডা, বানিয়াখালী, শেখেরকোনা ও তেঁতুলতলার চর; কয়রা সদর ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড; উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের পাথরখালী ও কাটকাটা; মহারাজপুর ইউনিয়নের পূর্ব মঠবাড়ি, মঠেরকোনা গ্রাম হরিণশিকারি চক্রের তৎপরতা দেখা যায়। দাকোপ উপজেলার ঢাংমারী, খাজুরা, বানীশান্তা, সুতারখালী ও কালাবগি গ্রামের চিহ্নিত হরিণ শিকারিরা রাতে এবং দিনে দলবদ্ধভাবে সুন্দরবনে ঢুকে নিয়মিত হরিণ শিকার করে। এছাড়া বাগেরহাটের মোংলার চিলা, জয়মনি, বৈদ্যমারী, কাটাখাল কুল, বাঁশতলা ও কাটাখালী; মোরেলগঞ্জের জিউধরা, গুলিশাখালী ও সন্ন্যাসী; শরণখোলার ধানসাগর, তাফালবাড়ী, সোনাতলা, পানিরঘাট, রাজাপুর, রসুলপুর ও চালিতাবুনিয়া; সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের বেশকিছু গ্রামেও এরা তৎপর আছে।

গত ১৫ জানুয়ারি রাতের অন্ধকারে গহিন বন থেকে অবৈধভাবে হরিণ শিকার করে মাংস নিয়ে ফিরছিল চোরাশিকারি দল। সুন্দরবনের সত্যপীরের খাল ধরে লোকালয়ের দিকে যাওয়ার সময় কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের বনরক্ষীরা তাড়া করে। এ সময় নৌকার মধ্যে মাংসের বস্তা ফেলে পালিয়ে যায় তারা। পরে ওই নৌকা থেকে ৩টি বস্তায় থাকা ৮০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করে বনরক্ষীরা।

আরও পড়ুনঃ  শেখ হাসিনাসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা

এর আগে, গত ৭ জানুয়ারি দুপুর ২টায় মোংলার ফেরিঘাট এলাকা থেকে ১১ কেজি হরিণের মাংসসহ ৬ জনকে আটক করে কোস্টগার্ড। কোস্টগার্ড জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মোংলা থেকে ঢাকাগামী একটি মাইক্রোবাস তল্লাশি চলিয়ে ১১ কেজি হরিণের মাংসসহ ছয়জন চোরাচালানকারীকে আটক করা হয়। আটক ব্যক্তিরা হলেন— মো. রবিন (৪০), তাইজুল ইসলাম (৩৮), সোহেল হোসেন (৩৯), সাইদুল ইসলাম (৪৭), কল্পনা আক্তার নাজু (৩০) ও মুক্তা আক্তার (৩২)। তাদের সবার বাড়ি ঢাকার কেরানিগঞ্জে।

গত ৩ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টার দিকে খুলনার কয়রা উপজেলার কালনা বাজার এলাকায় প্রায় ৩০ কেজি হরিণের মাংসসহ ইকবাল মোড়ল নামের একজনকে আটক করে পুলিশে দেয় স্থানীয়রা। ২৩ বছর বয়সী ইকবাল পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নের বাসিন্দা।

কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জি এম ইমদাদুল হক জানান, জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল জানিয়েছেন, কয়রার সুন্দরবন এলাকা থেকে মনিরুল ইসলাম নামের এক হরিণ শিকারি তাকে এ মাংস দিয়েছিল। ৩০ কেজি হরিণের মাংস নিতে মনিরুলকে ২৪০০ টাকা দিয়েছেন। হরিণ শিকারি মনিরুলের সঙ্গে আগে থেকেই ইকবালের পরিচয় ছিল।

খালের চরে হরিণের দল

কয়রার স্থানীয়রা জানান, কয়রা উপজেলা ঘিরে রেখেছে কপোতাক্ষ, কয়রা এবং শাকবাড়িয়া নদী। উপজেলাটি তিন দিক নদীবেষ্টিত এবং ৭টি ইউনিয়ন সুন্দরবনের সীমানায় অবস্থিত। এই গ্রামগুলোতে বেশিরভাগ শ্রমজীবী মানুষ বসবাস করে। এসব গ্রামের প্রতিটি পরিবার সুন্দরবনকেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে জড়িত। এ উপজেলার ৩০টির বেশি চোরাশিকারি চক্র সুন্দরবনের হরিণ নিধন করে আসছে।

কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা শহিদুল সরদার বলেন, উপজেলার একটি ছোট নদী পেরোলেই সুন্দরবনের গহিন জঙ্গল। পেশাদার হরিণ শিকারিরা গোপনে সুন্দরবনে ঢুকে দড়ির ফাঁদ পেতে রাখে। চলাচলের সময় হরিণ সেই ফাঁদে আটকে যায়। তারপর বনরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হরিণের মাংস বিক্রি করা হয়। এক মাস ধরে এলাকায় হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুন্দরবনঘেঁষা মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, স্থানীয় পদ্ধতিতে মাংস, চামড়া, মাথাসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করে পাচার করে চোরাশিকারিরা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে এজেন্ট-ব্যবসায়ীদের। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনও অগ্রিম অর্ডার, আবার কখনও মাংস এনে তারপর বিক্রি করা হয়। এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায় হরিণের মাংস।

আরও পড়ুনঃ  মুসল্লিদের প্রতিরোধের মুখে শেখ হাসিনার নিযুক্ত খতিব রুহুল আমিনের পলায়ন

ক্রেতারাও অনেক সময় প্রতারণা ভেবে হরিণ নিজ চোখে না দেখে মাংস কিনতে চান না। তাই চোরাশিকারিরা জীবন্ত হরিণ লোকালয়ে এনে জবাই করে। অবৈধ জেনেও হরিণের মাংস কেনেন মানুষ।

ধনাঢ্য ব্যক্তিরা হরিণের মাংস দিয়ে উৎসব পালন করেন। কেউ কেউ স্বজনদের হরিণের মাংস উপহার দেন। আবার বড় ধরনের স্বার্থসিদ্ধির জন্যও কর্তা ব্যক্তিদের খুশি করতে গোপনে হরিণের মাংস সরবরাহ করা হয়। হরিণের চামড়া-শিং সৌখিন ব্যক্তিরা সংগ্রহ করে ড্রইংরুম সাজান।

খুলনার সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে বাঘ হত্যা কিছুটা কমলেও একেবারে তা বন্ধ হয়নি। আর বাঘের প্রধান খাবার হরিণ শিকার হচ্ছে প্রায়ই।

অধ্যাপক কাদির বলেন, বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ চিত্রা হরিণ শিকার করছে কয়েকটি চক্র। যে পরিমাণ হরিণের মাংস ও চামড়া আটক হয়, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি পরিমাণ হরিণ শিকার করা হয়। মাঝে মধ্যে দুই একটি অভিযানে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা উদ্ধার হলেও মূল শিকারি ও পাচারকারীরা আটক হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হরিণের মাংস বহনকারীরাই ধরা পড়ে। আর যারা আটক হন, তারা দুর্বল আইনের কারণে কয়েকদিন পর জেল থেকে ফিরে একই কাজে লিপ্ত হন।

সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী শুভ্র শচীন বলেন, বনের পাশে যাদের বাড়ি, তারাই বেশি হরিণ শিকারের সঙ্গে যুক্ত। সুন্দরবনের, ৪টি রেঞ্জ সংলগ্ন গ্রামগুলোয় দেড় শতাধিক শিকারি দল রয়েছে। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর এবং বাগেরহাটের মোংলা ও শরণখোলার মানুষ বেশি হরিণ শিকার করে থাকেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বনজ সম্পদ আহরণসহ নানা উপায়ে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের আয় কমেছে। যে কারণে বনজীবীদের কেউ কেউ জীবীকার তাগিদেও এসব কাজে লিপ্ত হচ্ছেন।

আরও পড়ুনঃ  তাহসানের বিয়ের খবরের দিনে যা করলেন মিথিলা

সুন্দরবনের ভেতরে হরিণ

খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, মূলত শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের ভেতরে খাল ও নদীতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হরিণের বিচরণ বেড়ে যায়। যে কারণে চোরাশিকারিরা এ সময় তৎপর হয়। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু শিকারের ঘটনা ঘটলেও সেটা আগের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম। অল্প জনবল দিয়ে এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয় বন বিভাগের।

শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারণেই মাংসসহ হরিণ শিকারি ধরা পড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী শিকারিদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ তথ্য দিলে সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়। হরিণের ক্ষেত্রে বনের ভেতরে অপরাধ উদঘাটনের তথ্য দেওয়ায় ২০ হাজার টাকা এবং বনের বাইরে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া আছে।

কয়েক বছরে বনের জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন এসেছে মন্তব্য করে মিহির কুমার দো বলেন, সুন্দরবনে গেলেই হরিণ দেখা যাচ্ছে, যা আগে ছিল না। হরিণের সঙ্গে বাঘও দেখতে পাচ্ছেন পর্যটকরা। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বন বিভাগের নিয়মিত টহল বৃদ্ধি এবং বন দস্যু মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি রাসমেলা বন্ধের কারণে হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেক কমেছে।

উল্লেখ্য, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে পা দিলেই এখন দেখা মেলে হরিণের। পর্যটক, দর্শনার্থী এবং স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সম্প্রতি সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা বেড়েছে। সুন্দরবনের বাঁকে বাঁকে এখন হরিণের দেখা মেলে। বনের খাল বা নদীর ধারে দলবেঁধে হরিণের চলাফেরা করছে। সুন্দরবনে মায়া ও চিত্রল নামের দুই প্রজাতির হরিণের দেখা যায়। তবে এর মধ্যে চিত্রল হরিণের সংখ্যাই বেশি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) জরিপের তথ্যমতে, বর্তমানে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি হরিণ রয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালে হরিণের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজারটি। সেই হিসেবে ১৯ বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে হরিণ বেড়েছে ৫৩ হাজার ৬০৪টি।

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ