22 C
Dhaka
Thursday, February 20, 2025

১৬ বছর কারাভোগের পর বাড়ি ফিরেছেন সিপাহি শহিদুল

১৬ বছর কারাভোগের পর বাড়ি ফিরেছেন সিপাহি শহিদুল
দীর্ঘ ১৬ বছর কারাগারে থাকার পর বাড়ি ফিরেছেন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার শহিদুল ইসলাম। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলায় জেল হয় তার। গত ২৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। শহিদুল শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতল ইউনিয়নের আরজিপারাসলাই গ্রামের আলতাফ আলীর (৭৫) ছেলে।

২০০৯ সালে ঘরে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, ঘাড়ে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে লন্ডভন্ড শহিদুলের জীবন। বিচারে সাজা নিয়ে জেলহাজতে বন্দি শহিদুল। ছাড়া পান গত বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি)। বাড়ি ফিরে দেখেন, তার স্ত্রীর গর্ভে থাকা সেই সন্তান এখন কিশোরী। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন একমাএ আদরের ছোট ভাই সাজু। ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে। নিজেরও বয়স বেড়েছ, কমেছে শরীর ও মনের জোর। জীবনের ১৬টি বছর নিঃসঙ্গ কাটিয়েছেন তার স্ত্রী শিল্পী খাতুন।

দীর্ঘদিন পর মা-বাবা, ভাই-বোনদের কাছে পেলেও হতাশা কাটছে না শহিদুলের। বন্দি দশা থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর সবকিছুই এখন তার চোখে নতুন। এরি মধ্যে কিভাবে কাটাবেন বাকিটা জীবন সেই দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছে সদ্য জেল থেকে মুক্তি পাওয়া শহিদুলকে।

২০০৯ সালে বাংলাদেশ রাইফেল সপ্তাহ উপলক্ষে পিলখানায় অবস্থান করছিলেন সিপাহি শহিদুলসহ তার গ্রুপ। তিনি বলেন, দরবার মহলে সংঘটিত হয় পিলখানা হত্যাকাণ্ড। কিন্তু আমরা যেখানে অবস্থান করছিলাম সেটি প্রায় হাফ কিলোমিটার দূরে। আমারা সৈনিক ব্যারাকের ৫ তলায় অবস্থান করছিলাম। ২৫ তারিখে হঠাৎ গোলাগুলি শব্দ শুনতে পাই। আমরা বিল্ডিংয়ে অবস্থান করছিলাম। ২৬ তারিখ যখন দেখলাম সবাই পিলখানা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বুঝলাম এখানে থাকা সম্ভব হবে না, র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করছে। তখন আমিও ২৬ তারিখ বিকেল ৫টায় পিলখানা থেকে বেরিয়ে বাড়ি চলে যাই।

আরও পড়ুনঃ  উপদেষ্টা ফারুকী-বশিরের পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ

পরে সরকার যখন সার্কুলার দিয়ে জানায়, নিজ নিজ ইউনিটে যোগ দিতে। তখন আবারও পিলখানায় যোগ দিলে আমাদেরকে ধাপে ধাপে জেলহাজতে নিতে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই থেকেই ঘর ছাড়া আমি।

বাড়িতে রেখে যাওয়া এক মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, গর্ভের সন্তানকে আঁকড়ে বাঁচা স্বপ্ন দেখেন। শিল্পী খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এসব বলতে গেলে কান্না চলে আসে। সেদিন একটু আগে আমার স্বামীর সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তিনি আমাকে জানান, প্যারেড শেষ করে বাড়ি ফিরবেন। পুঁইশাক ও ছোট মাছ রান্না করতে বলেছিলেন। বাজার থেকে শাকসবজি কিনে নিয়ে এসে রান্না করতে যাব তখনই টিভিতে দেখি পিলখানার খবর। তখন তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পারিনি। পরে দু’দিন পর বাসায় ফিরে আসেন তিনি। কিছু দিন পরে সরকারি নির্দেশে যখন পিলখানায় নিজ ইউনিটে যোগ যোগদান করেন তখন তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।

আরও পড়ুনঃ  গোপন গুমখানা ‘আয়নাঘর’ যা জানালো আনন্দবাজার

দীর্ঘ ১৬ বছরে শিল্পী খাতুনকে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। স্বামী জেলে যাওয়ার ৯ মাস পরেই জন্ম নেন ফুটফুটে কন্যা সন্তান। সন্তানের মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে সন্তানকে লালন-পালন করার চিন্তা থেকেই যুক্ত হন আনন্দ স্কুল নামক প্রতিষ্ঠানে। বিধিবাম স্কুলটি ছিল স্বল্পমেয়াদী। যে কারণে আবারও হতাশায় পড়েন শিল্পী খাতুন। সন্তানের খরচ জেল হাজতে স্বামীর খরচসহ পরিবারের খরচ চালাতে না পেরে দ্বারস্থ হন ভাইদের কাছে। বাবার বাড়ির সম্পত্তি বিক্রির টাকা নিয়ে সংসার চালান শিল্পী খাতুন। এরপর দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর, বছর গড়িয়ে যুগ অতিবাহিত হয়ে যায়।

এদিকে গর্ভধারিনী মা জহুরা বেগম (৬৫) ও বাবা আলতাফ আলী (৭৫) অপেক্ষার পালা ফুরিয়ে এসেছে। প্রবীণ এই বৃদ্ধার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছেলে বাড়ি ফেরায় খুব ভালো লাগছে বাবা। বুকের ধন বুকে ফিরে আসছে। দীর্ঘদিন বুকে পাথর নিয়ে বেঁচেছিলাম। ছেলে একবার হলেও বাড়ি আসবে এ আসায় ছিলাম।

আরও পড়ুনঃ  ‘অহরহ কল আসছে, আমাকে উপদেষ্টা হিসেবে দেখতে চায়’

অপরদিকে বাবার অনেক গল্প গুনেছে ইসরাত জাহান সৌমিকা (১৫)। কিন্তু বাবার সাক্ষাৎ পেয়েছে ১৬ বছর পর। সৌমিকা বলে, দীর্ঘ সময় পর আমি আমার বাবাকে কাছে পেয়েছি। জন্মের পর থেকে আমার কখনো বাবাকে ছুয়ে দেখা হয়নি। স্কুলে সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করতো, তোর বাবা কেন জেলে? আমি উওর দিতে পারিনি। স্থায়ীভাবে মামলা বাতিল করে আমার বাবাকে চাকরি ফিরিয়ে দিলে, আমি সবাইকে বুক ফুলিয়ে বলতে পারব আমার বাবা নির্দোষ।

শহিদুলের সমবয়সী ফুফাতো ভাই হারুন বলেন, তার একটা মেয়ে সন্তান হইছে কিন্তু মেয়ে যে বাবাকে দেখবে সেই সুযোগ এর আগে সুযোগ হয়নি। তার বাবা-মা বৃদ্ধ, ছোট ভাই ক্যান্সারে মারা গেছে। তাদের পরিবারে ২ মেয়ে আছে। শহিদুল তো একেবারে হতাশ। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। না আছে টাকা, না আছে করে খাওয়ার মতো কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

শহিদুল বলেন, পিলখানা হত্যা মামলার বিচার চলাকালীন আমাদেরকে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু যাদেরকে পরে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে নিয়ে আসে তাদেরকে অনেক নির্যাতন করা হয়েছে। কাউকে গুম করেছে, কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। সবশেষ যাদের মাধ্যমে ১৬ বছর পর ফিরে আসতে পেরেছি তাদেরকে প্রতি কৃতজ্ঞতা।

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ